কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ
একটি অশান্ত বাংলাদেশের উত্তাল কালপর্বে উদয় হয়েছেন কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। তিনি একাধারে প্রেম, দ্রোহ, স্বপ্ন, সংগ্রাম ও প্রকৃতির নিবিষ্ট সাধক ছিলেন। মাটি, মানুষ ও যাপিত জীবনের কাহিনি তিনি তার কাব্যে সূক্ষ্মভাবে তুলে ধরেছেন। তার বলিষ্ঠ উচ্চারণে, চোখে দেখাÑ অসাম্য, শোষণ, স্বৈরাচার ও সাম্প্্রদায়িকতার ভিত নড়েচড়ে ওঠে। ১৯৫৬ সালের ১৬ই অক্টোবর তিনি জন্মগ্রহণ করেন বরিশাল জেলার আমানতগঞ্জের রেডক্রস হাসপাতালে। পিতা ডা. শেখ ওয়ালীউল্লাহ (১৯৩৩-১৯৯৬), মাতা শিরিয়া বেগম (১৯৪৪-২০০৪)। কবির পৈত্রিক নিবাস বাগেরহাট জেলার মোংলা থানার অন্তর্গত সাহেবের মেঠ গ্রামে। তিনি শিশুবেলা থেকেই প্রকৃতিকে খুব যতনে বুকের ভেতর লালন করেছেন। শৈশব নানাবাড়িতে কাটলেও সমগ্র বাংলাদেশই তার চোখে ঘুরেফিরে ধরা দিয়েছে। তার কবিতায় উঠে এসেছে মিষ্টি প্রেমের পঙ্ক্তিÑ
যেভাবেই ভাঙোÑ দুজনাই শুধু ভাঙি,/ যেভাবেই ভাঙিÑ ভাঙি শুধু দুজনাই।/
তুমি যদি তোলো পাথরের ইমারত,/ আমি তাকে ভাঙি নিসর্গ ভালোবেসে।
(সীমাবদ্ধ ভাঙচুর)
চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় তিনি লেখালেখির প্রতি ঝুঁকে পড়েন। মামাতো ভাইদের সঙ্গে নিয়ে নানির ট্রাংক থেকে টাকা চুরি করে গড়ে তোলেন ‘বনফুল’ নামের লাইব্রেরি। তারপর ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান। কিশোর শহিদুল্লাহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গণআন্দোলনের কর্মসূচিতে যোগ দেন। হরতাল, মিছিল, মিটিংয়ে নিয়মিত অংশ নেন তিনি। লেখেন রাজনৈতিক কবিতা।
বাতাসে লাশের গন্ধ ভাসে,/ মাটিতে লেগে আছে রক্তের দাগ।/
এই রক্তমাখা মাটির ললাট ছুঁয়ে একদিন যারা বুক বেঁধেছিলো,/
জীর্ণ জীবনের পুঁজে তারা খুঁজে নেয় নিষিদ্ধ আঁধার।
(বাতাসে লাশের গন্ধ)
বাংলাদেশের কবিতা গত কয়েক দশকে তার স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্যের রূপ-রেখা-বিচারে এখন অনেকটা এগিয়ে। বাংলা কবিতার ঐতিহ্য-চরিত্র চর্যাপদ থেকে আজকের উত্তরাধুনিককাল পর্যন্ত বিবেচনায় এসেছে। বাংলাদেশ রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দের মতোই কবিতার দেশ। এদেশে স্বপ্ন ওড়াওড়ি করে। জলে ভেসে যায় অসংখ্য কবিতার কথা। সেখানে রুদ্রের কবিতাও কথা বলে। সত্য যে কোনো ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর শিল্পসাধনার ক্ষেত্র। শিল্প সৃষ্টির নানা ফর্মে সমাজচেতনা, মানবিক গুণ, প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের প্রভাব অস্বীকার করা চলে না। বাঙালি এখনো তাদের ভূমিনির্ভর গ্রাম, পাখির কিচিরমিচির, শাপলার ঝিল, শস্যদোলা মাঠ, শহর-নগরের শিকড়সংলগ্ন মানুষ।
এদের নিয়েই বাংলাদেশের কবিতা তার ভাষিক ও প্রকরণিক উভয় দিক থেকেই বিভাগপূর্ব সময় থেকে দ্বৈত চরিত্রের অভিসারী। আগে কবিতার গভীর প্রাকরণিক চর্চার অবকাশ ততটা ছিল না, এখন যতটা আছে। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কবিতায় আমরা সেরকম শিকড়সংলগ্ন মানুষের প্রাণ পাই।
পঞ্চাশী দশকের প্রধান পর্বে (১৯৫২-১৯৫৮) কবিতা প্রধানত সমকালীন বিস্ফোরক রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ফসল। আধুনিক চেতনায় এক উর্বর ভূমি। মানসিকতা ও সমাজচেতনার এক ধারাবাহিক রূপ ফুটে ওঠেছে। তারই ধারাবাহিকতায় কবি রুদ্র ‘আজীবন জন্মের ঘ্রাণে’ কবিতায় টোটাল বাংলাদেশের চিহ্নই আঁকতে চেয়েছেনÑ
মা-কেই ঈশ^র ভেবে হয়তো দারুণ প্রতিজ্ঞায়/অবুঝ হাত-পা ছুঁড়ে তীব্র প্রতিশোধ জে¦লে আমি/
তছনছ কোরে ফেলেছিলাম ডেটল-শাদা তুলো/ অথবা ধাত্রির শুভ্র ধবলিমা বসন।
(উপদ্রুত উপকূল)
‘মাইকেল হইতে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত বাঙালির সাহিত্য-জীবনের ধারা এবং গতি প্রকৃতির নানা দিক আছে। এজন্য সাহিত্যের উৎপত্তি তাহার প্রধান প্রবৃত্তি এবং বর্তমান পরিণতির কথা আর এক দিক দিয়া অনুধাবন করিবার প্রয়োজন আছে।’ মোহিতলাল মজুমদারের এমন কথার সূত্র ধরেই বাংলাদেশের কবি-সাহিত্যিকগণ সামনের দিকে হেঁটেছেন। হাঁটছেন। রুদ্রও হেঁটেছেন সময়ের বাঁকে বাঁকে। সময়ের ব্যবধানে দিন দিন কবিতার রূপ-রস-ছন্দ-ঘ্রাণ বিকশিত হতে হতে সমগ্র বিশে^ ছড়িয়ে পড়েছে। কবিদের কথা উঠে এসেছে বিশে^ যুদ্ধ-বিগ্রহ-সংঘাত, প্রেম-ভালোবাসা ও সমসাময়িক বিষয়-আশয়। তাই তো ‘বিশ^াসে বিষের বকুল’ কবিতায় কবি বলতে চেয়েছেনÑ
যদি সব নদী ফিরে আসে নীড়ে, জন্মের নিকটে,
তবু শরীরে ঘামের গন্ধ আমি তো ফিরিনি আজো
কাব্যের বৈশিষ্ট্য হলো অনুরাগে প্রেমের উন্মেষ। বিরহে তার বিকাশ কিন্তু মিলনেই তার সার্থকতা। যে প্রেম মিলনমুখী নয়, তাতে আছে কেবল দাহ, মন-আত্মা-দেহের অপমৃত্যুই তার পরিণামÑ সেখানেই কাব্য সার্থক হয়ে ওঠে। একজন কবিই ভাববেন কীভাবে তার মনের ভেতরের কথাগুলো বইয়ের পাতায় কাব্যিক রূপ পাবে। যিনি যতটা সুন্দর করে লেখার পাতায় উপস্থাপন করবেন তিনিই আধুনিক ও সার্থক কবি। কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহও একজন আধুনিককালের সার্থক কবি। কবি রুদ্র ‘এক গ্লাস অন্ধকার’ কবিতায় বলেছেনÑ
এক গ্লাস অন্ধকার হাতে নিয়ে বোসে আছি।/ শূন্যতার দিকে চোখ, শূন্যতা চোখের ভেতরেওÑ/
এক গ্লাস অন্ধকার হাতে নিয়ে একা বোসে আছি।
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কবিতা দ্রোহ ও সংগ্রামী চৈতন্যে আত্মা-স্বরূপ। তার কবিতার প্রতিটি শব্দে এক-একটি ইতিহাস জড়িয়ে আছে জীবনের সাথে। তার কবিতায় প্রেম, দ্রোহের পাশাপাশি উঠে এসেছে সাম্যবাদী সমাজ নির্মাণের প্রত্যয়। তিনি মৃত্তিকার পরতে পরতে খুঁজেছেন কবিতার শব্দ। পাঠকদের চিনিয়েছেন নতুন ভুবন। তিনি কাব্যচর্চার সমান্তরালে সাংগীতিক সক্রিয়তায়ও সুবিদিত ছিলেন। জীবনের শেষ দিকে রুদ্র গানের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। গান রচনার পাশাপাশি সুরারোপও শুরু করেছিলেন। তার কবিতার ভাষা, বানানরীতি, শব্দ চয়ন, নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল। ছিলেন অভিনেতা, নাট্যনির্দেশক। রুদ্রের পিতার আকাঙক্ষা ছিল ছেলে বড় ডাক্তার হবে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের আগ পর্যন্ত কবিরও স্বপ্ন ছিল তাই। কিন্তু তৎকালীন যুদ্ধ-বিগ্রহ দেশের চিত্র দেখে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ডাক্তার না হয়ে হলেন বাংলাদেশের আধুনিক কবিদের অন্যতম একজন কবি। দৈনিক আজাদ পত্রিকার সাহিত্য পাতায় তার প্রথম কবিতা ‘আমি ঈশ^র আমি শয়তান’ নামে প্রকাশিত হয়। কবি বনে গেলেন তিনি। তারপর বাকিটা ইতিহাস। ‘উপদ্রুত উপকূল’ কাব্যগ্রন্থের জন্য সংস্কৃতি সংসদ থেকে মুনীর চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। কবির কবিতা লেখার প্রতি তৃষ্ণা আরো বেড়ে যায়। একের পর এক তিনি গ্রন্থ উপহার দেন পাঠকদের।
কবির জীবদ্দশায় প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ৭টি। উপদ্রুত উপকূল (১৯৭৯), ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম (১৯৮১), মানুষের মানচিত্র (১৯৮৪), ছোবল (১৯৮৬), গল্প (১৯৮৭), দিয়েছিলে সকল আকাশ (১৯৮৮), মৌলিক মুখোশ (১৯৯০)। পরে প্রকাশিত হয় এক গ্লাস অন্ধকার (১৯৯২), বিষ বিরিক্ষের বীজ (কাব্যনাট্য; ১৯৯২), সোনালি শিশির (গল্পগ্রন্থ; ২০০৫)।
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ’র মানস গঠনে প্রকৃতি, দেশ ও মাটির সন্ধানে সংকীর্ণতাকে দূরে ঠেলে বিস্তৃর্ণ পথে হেঁটেছেন। কবিতাকে তিনি কোনো ফ্রেমে আটকে রাখতে চাননি। তিনি বারবার মানব প্রজাতির গহিন থেকে তুলে এনেছেন এক নতুন ইতিহাস। বিংশ শতাব্দীতে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যখন বিশ^ তখন সেই ছোঁয়া বাংলাদেশের বুকেও লেগেছে। সেই ব্যবস্থা মানবসমাজকে করেছে আরো স্বার্থপর, সম্পর্কশূন্য আর অসহায়। কবির কলমে অনায়াসে সেইসব বিষয় উঠে এসেছে। কবির ‘তছনছ বিশ^ামিত্র’ কবিতায় তারই ইঙ্গিত পাওয়া যায়Ñ
কে তুমি দাঁড়ালে এসে মানব মেনকা?/ ছিঁড়ে গেল নিমগ্ন সেতার,/
তৃষ্ণা বাড়ালো দুহাত শোণিতের নিভৃত শিকড়ে/ জ¦’লে উঠলো আগুন/
ধারালো বর্ধিষ্ণু এক কোমল আগুন।
বাংলাদেশের উত্তরাধুনিক কবিতার বিষয়-আশয় ষাটের দশকের কবিতাতেই শুরু হয়েছিল। সময়ের ধারাবাহিকতায় নব্বই দশক পার হয়ে শূন্য দশকে পৌঁছলেও শুরুটা হয়েছিল মূলত ষাটের দশক থেকে। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কবিতায় আমরা ষাটের দশকের সেই আধুনিকতা লক্ষ করি। তার কবিতায় আধুনিক ভাবনার ছায়াপাত ঘটেছে অহরহ। তবে কবি হুমায়ুন আজাদ আধুনিক কবিতা বলতে পূর্ব-বাংলার কবিতাকে অপ্রাপ্ত বয়স্কদের কবিতা বলে মন্তব্য করেছেন। সেদিক থেকে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ সম্পূর্ণই আলাদা। তার কবিতায় আধুনিক ভাষা, সভ্য সমাজ, গ্রম-বাংলার আবহ, রাজপথের উত্তাল কন্ঠস্বর খুব পরিণতভাবে উঠে এসেছে। ‘কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প’ কবিতায় তেমনি কথার ছাপ রেখেছেন তিনিÑ
তার চোখ বাঁধা হলো।/ বুটের প্রথম লাথি রক্তাক্ত করলো তার মুখ।/
থ্যাতলানো ঠোঁটজোড়া লাল রক্তে একাকার হলো,/
জিভ নাড়তেই দুটো ভাঙা দাঁত ঝ’রে পড়লো কংক্রিটে।
উনিশ শতক পার হওয়ার পর বিশ শতকের বাঙালির প্রতিভার মহত্তম সৃষ্টি আধুনিক বাংলা কবিতা। বিশ শতকের মতো অভিনব ও উৎকৃষ্ট কবিতা লেখা হয়নি আর কোনো শতকে। এদিক থেকে রুদ্র বিশ শতকের কবিদের একজন হতে পেরেছেন। তার কবিতায় চোখে পড়ে বিভিন্ন মাত্রার উন্মত্ততা। ছন্দ ও কথার ঝিলিক।
কবিতা এমন এক শক্তি যে শক্তির মাধ্যমে সমাজের অশুভ শক্তি ভেঙে এক নতুন সমাজ গড়া যায়। কবিতা তার সৃষ্টির ক্ষেত্রে, ভাববস্তুর ক্ষেত্রে দ্বৈত চেতনার পথ ধরে চলতে অভ্যস্ত। দ্রোহ ও সংস্কার মুক্তির মতো ভিন্ন চরিত্রে ভর করে প্রকাশ ঘটায়। তেমনি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহও তার কবিতায় দ্বৈত চেতনায় পথ সৃষ্টি করেছেন। তখন কবিতা হয়ে উঠেছে জীবনবাদী।
নদী যেমন চলতি পথে বাঁক নেয় কবিতাও তেমনি বাঁক নেয়। গতি বদলায়। কবিতায় জৌলুস আছে। আছে প্রকৃতির গান। সমাজসচেতন মানুষের কথা। যুদ্ধের কথা। ভালোবাসার কথা। রুদ্র তার কবিতায় এসব বিষয় এনেছেন আধুনিক ছন্দে। উৎপ্রেক্ষা-উপমায়। তার ‘সভ্যতার সরঞ্জাম’ কবিতায় দেখতে পাই-
রক্তে আগুন তোর, তুই এতো নমনীয় হোলি/ চন্দনে সিক্ত কপাল হোলি তুই বিন¤্র মাধবী!/
প্রাচীন পিঁচুটি চোখে তোর এতো দীর্ঘ হলো ঘুম/
তুই কোনো রাত্রি দেখলি না, কোনো সকালের সূর্য দেখলি না।
রুদ্র একজন কবি ছিলেন। ছিলেন মুক্তমনের মানুষ। তিনি তার প্রখর অনুভূতি দিয়ে চারপাশের সমাজ দেখতে চেয়েছেন। কবিতায় কবিতায় গড়তে চেয়েছেন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। তিনি কবিতাকে শিল্পের সর্বোচ্চ মাত্রায় স্থান দিয়েছেন। তার কবিতা প্রেম, দ্রোহ, আশা ও ভালোবাসায় হৃদ্য। কবিতায় শিল্পিত প্রতিবাদে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম।
কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ
কোন মন্তব্য নেই। প্রথম মন্তব্য করুন!